রাজ্জাক-শাবানা-ওয়াসিম-জসিম-জাম্বু আমলের বাংলা সিনেমায় দেখা যেত, গল্পের শুরুতে নায়কের বাবা-মাকে রাজিব টাইপের কোনো ভিলেন খুন করে। ঘটনাস্থলে পুলিশ আসে।
বাবা-মায়ের খুনের বিচার চেয়ে কিশোর বয়সী নায়ক আদালতে-থানায় দৌড়াদৌড়ি করতে থাকে। একপর্যায়ে তদন্ত কর্মকর্তা অধৈর্য হয়ে পড়া নায়ককে বিরক্ত হয়ে বলেন, ‘আইন তার নিজস্ব গতিতে চলে।’ কিন্তু আইন অনুযায়ী বিচার না পেয়ে নায়ক বড় হয়ে ভিলেনকে ছবির শেষ দিকে মেরে ফেলতে যান।
এই সময় টুপ করে এক পুলিশ কর্মকর্তা ফ্রেমে ঢুকে পড়েন। তিনি পিস্তল তাক করে বলেন, ‘আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না।’ সেই সব সিনেমার ‘মোরাল অব দ্য স্টোরি’ ছিল দুটি:
১. আইন একটি গতিশীল জিনিস। তার নিজস্ব গতি আছে। সে সেই গতিতে চলে।
২. আইন নিজের হাতে তুলে দেওয়ার জিনিস না। আইনকে আইনের লোকের হাতে তুলে দিতে হয়।
সাংবাদিক সাগর-রুনি হত্যা মামলায় আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন জমার সময় পেছানোর ধরন দেখে সেই বাংলা ছবির সংলাপগুলো মনে পড়ছে।
মামলাটির তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে জমা দেওয়ার তারিখ সে...ই...ই...ই ২০১২ সাল থেকে আইনের নিজস্ব গতিপথ ধরে পেছাচ্ছে। ১১ বছর ধরে তারিখ পেছাচ্ছে তো পেছাচ্ছেই। আজ ২০২৩ সালের ৭ আগস্ট তারিখ পেছানো সেঞ্চুরি করল। আগামী ১১ সেপ্টেম্বর প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পরবর্তী দিন ঠিক করেছেন আদালত। বিশ্বের অন্য কোনো মামলার ক্ষেত্রে এই ধরনের ঘটনা ঘটেছে কিনা তা গবেষণার বিষয় হতে পারে।
সবারই মনে থাকার কথা, ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারের ভাড়া বাসায় সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি খুন হওয়ার পর সে সময়কার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন (প্রয়াত) বলেছিলেন, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে খুনিদের গ্রেপ্তার করা হবে।
খুনের দুই দিন পর তৎকালীন আইজিপি হাসান মাহামুদ খন্দকারও বলেছিলেন, তদন্তে অনেক অগ্রগতি হয়েছে। তারপর ‘কত চন্দ্রভুক অমাবস্যা পেরিয়ে গেল’, কিন্তু সেই খুনিরা ধরা পড়া তো দূরের কথা, তদন্ত পর্যন্ত শেষ করা গেল না। প্রথমে এই মামলা তদন্ত করছিল শেরেবাংলা নগর থানার পুলিশ। তার চার দিন পর তদন্তভার নিয়েছিল ডিবি। ৬২ দিন তদন্ত করার পর ডিবি হাইকোর্টে বলেছিল, এই জিনিস বের করা তাদের পক্ষে সম্ভব না। এরপর আদালত র্যাবকে তদন্তের ভার দেন। সেই থেকে তারিখ পেছানো চলছে।
বিভিন্ন জটিল ও ক্লুলেস অপরাধের রহস্য উদ্ঘাটনের ক্ষেত্রে প্রায়শই আমাদের পুলিশ-ডিবি-র্যাব যে পারদর্শিতা ও সক্ষমতা দেখিয়ে থাকে, তা আমাদের বিস্মিত করে, মুগ্ধ করে।
এই লেখা যখন লিখছি, তার ঘণ্টা খানিক আগে একটি খবর পড়লাম। সেই খবরে দেখা যাচ্ছে, গত ডিসেম্বরে কুমিল্লার বরুড়ায় একটি বাঁশবাগান থেকে নাদিয়া সুলতানা ইমুর নামের একটি শিশুর গলায় ওড়না প্যাঁচানো লাশ উদ্ধার করা হয়েছিল।
সেই সময় সিআইডির ফরেনসিক দল শিশুটির নখের ভেতরে সামান্য ‘স্কিন ডাস্ট’-এর অস্তিত্ব পেয়েছিল। সাধারণত কাউকে চূড়ান্ত শক্তিতে ঠেকাতে চেষ্টা করলে খামচির পর এই ধরনের ক্ষুদ্র কণা নখের ভেতরে আটকে যায়। সেই স্কিন ডাস্টের ডিএনএ পরীক্ষার পর তাতে একজন পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তির প্রোফাইল মিলেছে। সেই সূত্র ধরে সিআইডি বের করে ফেলেছে, ইমুকে ধর্ষণের পর হত্যা করেছে জসীম উদ্দিন নামের এক লোক। এই ধরনের মেধাবী ও চৌকস অফিসার আমাদের বাহিনীতে অনেক আছেন।
সাগর-রুনি কোনো বাঁশ বাগানে বা বনে-জঙ্গলে বা মনুষ্য-বাসস্থান থেকে দূরের কোনো জায়গায় খুন হননি। তাঁরা যে ফ্ল্যাটে থাকতেন, সেখানে যে কেউ চাইলেই ঢুকতে পারে না। ভবনের প্রবেশপথ সিসিটিভি ক্যামেরার নজরের আওতায় ছিল।
ওই ভবনের আশপাশের ভবনেও সিসিটিভি ক্যামেরা ছিল। ঘরের মধ্য থেকে যখন তাঁদের লাশ উদ্ধার করা হয়, তখন তাঁদের একমাত্র ছেলে মেঘকেও সজ্ঞান অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল। আন্দাজ করি, এই পারিপার্শ্বিক অবস্থা দেখে এবং আমাদের তদন্ত কর্মকর্তাদের সক্ষমতা বিবেচনায় নিয়েই সে সময়কার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে খুনিদের খুঁজে বের করার বিষয়ে আত্মবিশ্বাসী ছিলেন। কিন্তু ঘটনার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে এমন কী ঘটে গেল যে, কোনো আলামত থেকে আর কিছু পাওয়া গেল না?
২০১২ থেকে ২০২৩ সাল। এই এগারো বছর কি অনেক সময় নাকি অল্প তা মহাজাগতিক হিসাবে কী বলে ভেবে কাজ নেই। নিতান্ত জাগতিক হিসাব ধরে এগোলে দেখা যাবে, এই এগারো বছরে রুনির মা আইনের নিজস্ব গতি অনুযায়ী তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের তারিখের পৌনঃপুনিক পেছানোর খেলা দেখতে দেখতে কবরে চলে গেছেন।
বাবা-মাকে হারানোর সময় যে মেঘের বয়স ছিল সাড়ে পাঁচ বছর, এই এগারো বছরে সে সাড়ে ষোলো বছরের কিশোরে পরিণত হয়েছে।
‘আইন ও আইনের দর্শন স্থাণু হতে পারে না; এটি একটি চলমান বিষয়’—এই ভাববাদী কথা শুনতে শুনতে মেঘের জীবনের আরও কত বছর পার হবে সে তা জানে না।
আজ শততম তারিখ পেছানোর শ্রাবণঘন দিনটিতে আকাশ মেঘে ভরে গেছে। আইনি তামাশার এই ‘সেঞ্চুরি’ দেখে সাগরের ছেলে মেঘের চোখেও হয়তো আজ অশ্রুবাহী মেঘ ঘনিয়েছে।
এই সেঞ্চুরি দেখে দেশের আইন-কানুন ও প্রশাসনিক রীতিনীতি সম্বন্ধে অনতিসচেতন কিশোর মেঘের মতো অনেকেরই মনে প্রশ্ন জাগতে পারে; ‘আইনের চোখে সবাই সমান’ ও ‘আইন তার নিজস্ব গতিতে চলে’—এই কথাগুলো কি তবে নিছকই গুজব?
See why other supporters are signing, why this petition is important to them, and share your reason for signing (this will mean a lot to the starter of the petition).
This petiton does not yet have any updates
At 500,000 signatures, this petition becomes one of the top signed on amarabedon.com!
By signing you are agree to the followingTerms & Condition and Privacy Policy.
Reasons for signing.
See why other supporters are signing, why this petition is important to them, and share your reason for signing (this will mean a lot to the starter of the petition).