মাতৃভাষায় উচ্চশিক্ষা অন্যরা পারলে আমরা পারি না কেন ???

আমাদের উচ্চশিক্ষায় কেন বাংলা ভাষার ব্যবহার করা সম্ভব হয় না? কেন বিদেশের বড় লেখকদের বইগুলোর অনুবাদ আমরা পড়তে পারি না? এত বড় বড় জ্ঞানতাপস দেশে জন্মেছেন, গত হয়ে গেছেন। তাঁরা নিজেরা বিদেশি লেখকদের মতো এতটা মানসম্মত লেখা লিখতে না পারুন, বিদেশি বইগুলোর যথাযথ মানসম্মত অনুবাদ করে অন্তত জাতিকে রক্ষা করতে পারতেন।

স্বীকার করতে কেউই দ্বিধাবোধ করবেন না যে বর্তমান যুগের শ্রেষ্ঠ একাডেমিক বইগুলো ইংরেজিতে লেখা। সেগুলো পরিপূর্ণভাবে আমরা হৃদয়ঙ্গম করতে পারি না। কারণ, তা আমাদের মাতৃভাষায় লেখা নয়। এমনকি আপনি যদি ইউটিউবেও কোনো একাডেমিক বিষয় সার্চ দিয়ে সহজে বুঝতে চান, বাংলায় মানসম্মত কনটেন্ট আপনি পাবেন না। এ ক্ষেত্রে ভারতীয়রা বলা চলে একপ্রকার বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলছেন। পড়ালেখার কিছু সার্চ দিলে হিন্দি ভিডিওতে নিউজ ফিড সয়লাব হয়ে যায় আর শুরু হয়ে যায়, ‘তো দোস্ত, আজ হাম দেখেঙ্গে...’।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে আমার পঠিত বিষয় আমার চিন্তা ও মননের জগতে নাড়া দেবে, ভাবনার জগতে আলোড়ন তুলবে। কিন্তু যদি হৃদয়ে ধারণ ও লালনই করতে না পারি, তবে তা মনোজগতে আলোড়ন কীভাবে তুলবে?

শরৎচন্দ্র যথার্থই বলেছিলেন, ‘ইংরেজি বা ফরাসি ভাষায় চিন্তা করা যায় না, ইংরেজি লিখতে পারো; কিন্তু মাতৃভাষাকে বড় করে না তুললে চিন্তা চিরদিন ছোট হয়ে থাকবে।’

ইসলামের যে স্বর্ণযুগ এসেছিল, জ্ঞান-বিজ্ঞানের সব শাখার মৌলিক আবিষ্কারে মুসলিমদের জয়জয়কার ছিল—তার পেছনে মূল অবদান ছিল অনুবাদগ্রন্থগুলোর। তৎকালীন খলিফারা পৃথিবীর বিষয়ভিত্তিক শ্রেষ্ঠ গ্রন্থগুলো আরবিতে অনুবাদ করার ব্যবস্থা করে গেছেন, যা পরবর্তী সময়ে তৈরি করেছে জগদ্বিখ্যাত সব মুসলিম বিজ্ঞানীকে।

আব্বাসীয় খেলাফতের সময় বাগদাদ শহরজুড়ে ছিল বৃত্তাকার ঐতিহাসিক ‘বায়তুল হিকমাৎ’, যেখানে পুরো বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের শ্রেষ্ঠ মনীষীদের নিয়ে আসা হতো আর তাঁদের লেখা গ্রন্থগুলোর আরবিতে অনুবাদ করা হতো। ইতিহাসে আছে, খলিফা মামুন অনুবাদকারীদের তাঁদের অনুবাদকর্মের ওজনের সমপরিমাণ স্বর্ণমুদ্রা উপহার দিতেন।

২.

সত্যেন বোস, যাঁর নামে হিগস-বোসন কণার নামকরণ, যাঁর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার জন্য রেফারেন্স লিখেছেন স্বয়ং আইনস্টাইন; সেই সত্যেন বোস বলেছেন, ‘যাঁরা বলেন বাংলায় বিজ্ঞানচর্চা সম্ভব নয়, তাঁরা হয় বাংলা পারেন না, নয় বিজ্ঞান বোঝেন না।’

আমার হাহুতাশ দেখে হয়তো আপনারা বলতে পারেন, ‘এই বিশ্বায়নের যুগে এসে কী বলছেন এসব? ইংরেজি না জানলে আমরা পুরো বিশ্বের সঙ্গে টেক্কা দিতে পারব?’

তাঁদের কাছে আমার সবিনয় প্রশ্ন, আমরা বর্তমান প্রজন্ম কতটুকু ইংরেজি পারি? কটা বাক্য আমরা ইংরেজিতে সাবলীলভাবে বলতে পারি? শতকরা হিসাবে বলতে গেলে ষাট-সত্তর দশকের একজন ম্যাট্রিকুলেশন পাস আমাদের বর্তমান মাস্টার্স পাসের থেকে ভালো ইংরেজি বলতে বা লিখতে পারবেন।

আমরা না পারি নির্ভুল বাংলা বলতে, না পারি ইংরেজি বলতে। বিদেশি ভাষায় দক্ষ হতে হলে আপনাকে আগে মাতৃভাষায় দক্ষ হতে হবে। অথচ ফেসবুকের কল্যাণে আজ বঙ্গসন্তানেরা এর অভূতপূর্ব ব্যবহার শিখে গেছেন। তাঁরা আজ ‘আমি খায়, সে যাই আর আমি ঘুমায়’ লিখে সদম্ভে ধরণির বুকে বিচরণ করেন।

৩.

মাধ্যমিকের পাঠ্যবইয়ে ‘জাদুঘরে কেন যাব’ নামের একটা প্রবন্ধ ছিল। যদিও প্রবন্ধটির নাম ও বিষয়বস্তু ছাত্রদের মধ্যে ব্যাপক বিদ্রূপের উদ্রেক ঘটাত। মনে হচ্ছে, একটা প্রবন্ধ লেখা আজ সময়ের দাবি হয়ে গেছে, নাম হবে ‘বইমেলায় কেন যাব?’

প্রশ্নের উত্তরটিও আমিই দিই। ফ্যাশন করতে আর কিছু ছবি তুলে ফেসবুকে আপলোড দিতে।

আজ আমাদের মধ্যে বই তো দূরের কথা, একটা বড় পোস্ট পড়ারই ধৈর্য নেই। শুদ্ধ বাংলায় লেখা বড় একটি পোস্ট পড়তে আজ আমাদের হাঁপানি উঠে যায়, রক্তে অ্যালার্জির প্রকোপে গায়ে জ্বালাপোড়া শুরু হয়।

ভুলক্রমে যদি এক-দুটি পড়ে ফেলি, পড়া শেষে দুই পাফ ইনহেলার ও একটি হিস্টামিনের বড়ি না নিলে গাত্রদাহ থেকে মুক্তি মেলে না।

অথচ কথা ছিল, আমরা দেশ-বিদেশের সেরা বইগুলো পড়ব, কল্পনাকে বিস্তৃত করব, পত্রিকার কলাম পড়ে তা নিয়ে ভাবব, রাজনীতি-সাহিত্য-সংগীত-অর্থনীতি-বিজ্ঞান নিয়ে সমালোচনা করব।

ছয় ইঞ্চির মুঠোফোন আর আমাদের মুঠোতে নেই। কী এক অদৃশ্য শিকলে আমরা বন্দী হয়ে আছি বরং মুঠোফোনের মুঠোতে। কোনো বিষয় নিয়ে আমরা ভাবতে পারি না।

ফেসবুক আর ইনস্টাগ্রাম রিলসের অতল গহ্বরে তলিয়ে যাচ্ছে আমাদের সব না-বলা কথা, না-ভাবা ভাবনা।

এই যদি অবস্থা হয়, তখন বইমেলায় বস্তা পচা আবর্জনা বের হবে, ভোকাবুলারি শিক্ষা কিংবা মোটিভেশনাল বইগুলো বেস্টসেলার হবে, সেটাই স্বাভাবিক।

শুনেছি, বইমেলার বেস্টসেলারের তালিকায় বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ষষ্ঠ স্থান অর্জন করেছেন। তথ্যটি সত্য হলে তাঁর সাত জন্মের কপাল বলতে হবে।

আজ এই সাহিত্যের মঙ্গা দশায় বিভূতি বাবুর ষষ্ঠ স্থান অর্জন খরার দেশে একপশলা বৃষ্টির মতোই বলা যায়।

শামসুর রাহমান যথার্থই লিখে গেছেন, ‘উদ্ভট উটের পিঠে চলছে স্বদেশ।’

আজ যেন সবাই লেখক। যাকে লেখার মতো লেখা বলে, তার চেয়ে আজ লেখকের সংখ্যা বেশি, সংগীতের থেকে আজ সংগীতজ্ঞ বেশি, ক্যাম্পাসের থেকে ক্যাম্পাস অ্যাম্বাসেডর বেশি, ছাত্রদের কারিকুলার অ্যাকটিভিটিজের থেকে এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাকটিভিটিজ বেশি।

থাক সে কথা।

আজকের জমানায় বাংলার বুকে দাঁড়িয়ে একটা বই প্রকাশ না করলে যেন জাতটাই থাকে না। আজ সবাই লেখক হতে চান। অথচ তাঁরা লেখা পড়তে চান না। দেশে আজ যত লেখক আছেন, তাঁদের অর্ধেকও পাঠক নেই।

৪.

আপনারা হয়তো বলে বসবেন, ‘আপনি ভাই খালি হতাশার গান শোনাচ্ছেন।’ না জনাব, আমি অত্যন্ত আশাবাদী মানুষ।

এখনো সময় আছে, এখনো সব নষ্টদের অধিকারে যায়নি।

সগৌরবে বাংলার চর্চা করুন, ভারতীয় দেখলেই হিন্দি বলা বন্ধ করুন। এমন অবস্থার সৃষ্টি করুন, যেন বিদেশিরা এ দেশে আসার পর বাংলায় বাধ্যতামূলক কোর্স পাস করতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্যবইয়ের মানসম্মত অনুবাদ করুন; প্রয়োজন হলে তা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায়। বই ও পত্র-পত্রিকা পড়ার জোয়ার সৃষ্টি করুন। অন্তঃসারশূন্য ও ভেতরের ফাঁপা তবলার ন্যায় মস্তিষ্কের সঙ্গে যোগ হওয়া সার্টিফিকেটের পাহাড়সম স্তূপের বোঝায় যখন শিক্ষিত তরুণদের ঘাড় নুইয়ে পড়ে, তখন লাইভে এসে সার্টিফিকেট পোড়ানো ছাড়া উপায় থাকে না।

মাথা নিচু করে থেকে বিদ্যার জাহাজ হওয়ার চেয়ে আত্মকে চিনে, নিজের দেশকে চিনে, রাজনীতি-অর্থনীতি-দর্শন জেনে ও স্বকীয় জীবনবোধ ধারণ করে ডিঙিনৌকা হয়ে বেঁচে থাকাও হাজার গুণ শ্রেয়।

শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড হলেও বঙ্গীয় শিক্ষাব্যবস্থার রোলারের নিচে পড়ে চিড়েচ্যাপটা হওয়া এই অমেরুদণ্ডী শিক্ষিত সমাজের প্রতি সমবেদনা ও শুভকামনা।

ছেলেকে ইংরেজি মাধ্যমে পড়িয়ে দুই পাটি দাঁত বের করে ‘আমার ছেলেটা না একদমই বাংলা পারে না’ বলে নির্লজ্জের মতো হাসা বন্ধ করুন। আপনার ছেলে শুদ্ধভাবে বাংলা বলতে না পারলে গর্বে বুক দুই ইঞ্চি চওড়া না করে লজ্জায় চার বিঘত সংকুচিত হয়ে যান বা গর্ত খুঁড়ে মাটিতে লুকিয়ে যান। 

কালির জবাব কালি দিয়ে, তুলির জবাব তুলি দিয়ে দিতে শিখুন; অপরকে গালি দিয়ে বা বন্দুকের গুলি দিয়ে মাথার খুলি উড়িয়ে নয়।

Reasons for signing.

See why other supporters are signing, why this petition is important to them, and share your reason for signing (this will mean a lot to the starter of the petition).

View All resone For signin

Reasons for signing.

See why other supporters are signing, why this petition is important to them, and share your reason for signing (this will mean a lot to the starter of the petition).

Recent News

This petiton does not yet have any updates

Administrator

Started This Abedon.

25 February 2024   2.9 K

0 have signed. Let’s get to 500,000 !

0%
Treands

At 500,000 signatures, this petition becomes one of the top signed on amarabedon.com!

Sign This

By signing you are agree to the followingTerms & Condition and Privacy Policy.

Must see setitions

তাপদাহে স্কুল খোলা নিয়ে এ কেমন মশকরা

তাপদাহে স্কুল খোলা নিয়ে এ কেমন মশকরা

পথের পাঁচালীর ‘প্রসন্ন গুরুমহাশয় বাড়ীতে একখানা মুদীর দোকান করিতেন। দোকানেরই পাশে তাঁহার পাঠশালা ছিল। বেত ছাড়া পাঠশালায় শিক্ষাদানের বিশেষ উপকরণ-বাহুল্য... Sign This
বেহাল প্রাথমিক বিদ্যালয় এর জমির বিরোধ মেটান, শিক্ষার পরিবেশ ফেরান

বেহাল প্রাথমিক বিদ্যালয় এর জমির বিরোধ মেটান, শিক্ষার...

দেশের অনেক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নতুন ভবন হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নে নানা বরাদ্দও দেওয়া হচ্ছে। সেই বরাদ্দ কাজে লাগিয়ে বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষগুলো নানাভাবে... Sign This
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে - নিয়োগে অনিয়ম ও অপচয় নিয়ে তদন্ত হোক

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে - নিয়োগে অনিয়ম ও অপচয় নিয়ে...

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও সহ-উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে গত রোববার থেকে শিক্ষক সমিতি যে কর্মসূচি নিয়েছে, সেটাকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলা যাবে... Sign This
উচ্চশিক্ষিত হয়েও কেন তরুণেরা বেকার ???

উচ্চশিক্ষিত হয়েও কেন তরুণেরা বেকার ???

বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশই তরুণ। এ দেশের কর্মসংস্থানেও তারুণ্যের ভূমিকা অসামান্য। স্বাধীনতার পর প্রায় সব খাতেই এগিয়েছে দেশ, বাড়ছে অর্থনীতির... Sign This
কুরুখ শিশুদের মাতৃভাষা শিক্ষার দায়িত্ব নিন

কুরুখ শিশুদের মাতৃভাষা শিক্ষার দায়িত্ব নিন

জাতীয় শিক্ষানীতিতে বাংলাদেশে বসবাসরত প্রতিটি জাতিসত্তার শিশুদের মাতৃভাষা শিক্ষার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বাঙালি ছাড়া অপরাপর জাতিসত্তার শিশুদের নিজ মাতৃভাষা... Sign This
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বৈধ ছাত্রদের হলে উঠতে দিন

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বৈধ ছাত্রদের হলে উঠতে দিন

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন অছাত্রদের আবাসিক হলে রেখে আর কত তোষণ করবে? প্রথম আলোর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি জানাচ্ছেন, ভর্তি পরীক্ষার পাঁচ মাস... Sign This
এইচএসসিতে শূন্য পাস, এসব কলেজ কীভাবে চলছে, কেন চলছে

এইচএসসিতে শূন্য পাস, এসব কলেজ কীভাবে চলছে, কেন...

গত রোববার এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করা হয়। এবার গড় পাসের হার ৭৮ দশমিক ৬৪। ৯টি সাধারণ শিক্ষা... Sign This
Loading