বর্তমানে বাংলাদেশের একটি গুরত্বপূর্ন আলোচনা হচ্ছে বিদ্যমান সংবিধান সংশোধন করে ২০২৪ এর গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী গণতান্ত্রিক যাত্রা শুরু করা। একইভাবে সমোচ্চারিত আরেকটি মতামত হচ্ছে নতুন করে সংবিধান প্রণয়ন করা । মূলত এই লেখায় আমরা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করব যে বর্তমান সংবিধান কিভাবে বাংলাদেশে একনায়কতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থা গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে বীজ বপন করেছে এবং কিভাবে জনমানুষের মৌল ও মানবিক অধিকারকে ভূলুণ্ঠিত করা হয়েছে।
সংবিধানের অধ্যায়-৩ এ উল্লেখিত মানুষের মৌল ও মানবিক অধিকারগুলো লিপিবদ্ধ হলেও এসব যেন ভুলন্ঠিত না হয় তার জন্য সংবিধানে যথেষ্ট রক্ষাকবচ তৈরি করা হয়নি। এই সংবিধানের মধ্যে থেকেই বিগত ১৬ বছরে এবং তার পূর্বের সরকারগুলোও রাষ্ট্রের নিরাপত্তা এবং শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখার দোহাই দিয়ে এমন কিছু আইন প্রণয়ন এবং সংস্থা তৈরি করেছে যা মৌলিক এবংমানবাধিকারের ধারাসমূহের পরিপন্থী। যেমন ডিজিটাল সিকিউরিটি এ্যক্ট, সন্ত্রাস বিরোধী আইন, এনটিএমসি(NTMC) এর মতো জঘন্য প্রতিষ্ঠান যেটা মানুষের অত্যন্ত ব্যক্তিগত ফোনালাপ বা টেলিফোনে আড়িপাতার মতো কাজে নিযুক্ত রয়েছে।
যাহোক উপরিউক্ত মৌলিক মানবাধিকারের সুরক্ষা বজায় রাখার ক্ষেত্রে বাত্যয় ছাড়াও বিদ্যমান সংবিধান বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন। প্রথমত সংবিধান প্রণয়ন ও সাংবিধানিক পরিষদ গঠন সংক্রান্ত মৌলিক কিছু সমস্যা রয়ে গেছে।১৯৭২ এর সংবিধান প্রণয়নের জন্য ১৯৭০ এর নির্বাচনে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের নিয়ে সাংবিধানিক পরিষদ গঠন করা হয়েছিল যার মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন কতটা যুক্তিসঙ্গত হয়েছে তার বিশ্লেষণ দরকার।
১৯৭২ সালে প্রণীত সংবিধানটি স্বাধীনতা পূর্ববর্তী আইয়ুব ও ইয়াহিয়া খানের সামরিক শাসনামলের সামরিক আবহে তৈরি হওয়া রাজনৈতিক আমলাতান্ত্রিক কাঠামো বা স্ট্রাকচার এর ভিত্তিতেই নির্মাণ করা হয়েছে। কিংবা অন্য অর্থে বলা যায় সেই স্ট্রাকচার বা কাঠামো থেকে এ সংবিধান বের হতে পারেনি। এছাড়া জনযুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে নেতৃত্ব প্রদানকারী ও রণাঙ্গনে লড়াই করেছেন এরকম অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের মতামত ৭২ এর সংবিধান প্রণয়ন করার সময় নেয়া হয়নি।
১৯৭১ এর জনযুদ্ধের একটা প্রধান গণআকাঙ্ক্ষা ছিল লিবারেল ডেমোক্রেসি প্রতিষ্ঠা। কিন্তু সেটাকে সংবিধানে ট্রান্সলেট করা হয়েছে অন্য বিরোধী মতাদর্শের সাথে সংমিশ্রিত করে, ফলে খুব শীঘ্রই চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে আমরা কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্র কাঠামোতে ঢুকে পড়ি। অথচ ৭১এ যুদ্ধের ময়দানে হাজির থাকা মুজিবনগর সরকারের পলিসিও তার চেয়ে বেশি গণতান্ত্রিক ছিল।
১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে জনগণের যে বয়ান সেটা সংবিধানে খুব বেশি স্বীকৃতি পায় নাই বরং সমাজের এলিটদের চাওয়া পাওয়াই প্রাধান্য পেয়েছে।এছাড়া এই সংবিধানকে কার্যকর করার পূর্বে একটি রেফারেন্ডাম বা গণভোটের আয়োজন করা হয়নি বরং জনগনের সাথে ডায়ালগ না করে তাদের উপর একটা শাসননীতি চাপিয়ে দেয়া হয়েছে।
দ্বিতীয়ত, জনগণের হাতেই নিরঙ্কুশ ক্ষমতা আছে বলে সংবিধানে ঘোষণা করা হলেও বাস্তবে দেখা যাচ্ছে পাঁচ বছরের জন্য একটি সরকার নির্বাচিত হয়ে তার খেয়াল খুশিমতো দেশ পরিচালনা করছে এবং রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর বৈদেশিক চুক্তি করছে। এ প্রক্রিয়ায় জনগণের মতামত নেওয়ার কোনো মেকানিজম নাই। গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে জনগনের রেফারেন্ডামও নেওয়া হয় না । একমাত্র ভায়োলেন্ট আন্দোলন ছাড়া এই সংবিধানে কার্যকরভাবে রাষ্ট্র পরিচালনায় জনগণের অংশগ্রহণের কোন ম্যাকানিজম নেই।
তৃতীয়ত, সাংবিধানিকভাবেই প্রধানমন্ত্রীর হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করার ফলে ক্ষমতা পৃথকীকরণের অভাব দেখা দিয়েছে এবং তা বিচার বিভাগ ও আইনসভাকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে না দিয়ে সাংবিধানিক স্বৈরতান্ত্রিক কাঠামো প্রতিষ্ঠার সুযোগ রেখে দিচ্ছে। কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্র-কাঠামোর গোড়াপত্তনের পিছনে আরেকটি কারণ হচ্ছে নির্বাহী বিভাগের অতিরিক্ত ক্ষমতা অর্থাৎ রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী হিসেবে প্রধানমন্ত্রী এবং তার শাসন বিভাগ অন্য দুটি বিভাগ যথা আইন এবং বিচার বিভাগের তুলনায় অধিকতর ক্ষমতাশালী হিসেবে ফাংশন করছে।
প্রধানমন্ত্রী আবার একই সাথে আইনসভার প্রধান এবং দলীয় প্রধান এবং তিনি ডি ফেক্টো রাষ্ট্রপ্রধান। যদিও রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে রাষ্টপতি নিয়োগ দেয়ার কথা কিন্তু কার্যত প্রধানমন্ত্রীই প্রধান বিচারপতি, প্রধান নির্বাচন কমিশন, মানবাধিকার কমিশন, অডিটর জেনারেলসহ অনেক পদে নিয়োগ দিয়ে থাকেন। এভাবে সাংবিধানিকভাবে নির্বাহী বিভাগের আধিপত্য তথা প্রধানমন্ত্রীর একচেটিয়া আধিপত্য রাষ্ট্রের প্রতিটি যন্ত্রে নিশ্চিত করা হয়েছে।
আগের দিনের আমির–খলিফারা শিক্ষকদের ও শিষ্টাচার শিক্ষাদানকারীদের সম্মান করতেন। তাঁদের দেখে সম্মানার্থে বাহন থেকে নেমে পড়তেন। এ কারণে শিক্ষকেরা সর্বস্তরের মানুষ থেকে খুব সম্মান পেতেন। একবার খলিফা হারুনুর রশিদ ইমাম মালিককে (র.) ডেকে লোক পাঠালেন। যাতে খলিফার দুই ছেলে আমিন ও মামুন তাঁর থেকে হাদিস শুনতে পারে। ইমাম মালিক অস্বীকৃতি জানালেন।
তিনি বললেন, ইলমের কাছে সবাই আসে, ইলম কারও কাছে যায় না। খলিফা হারুন দ্বিতীয়বার লোক পাঠালেন। বললেন, আমি আপনার কাছে আমার দুই ছেলেকে পাঠিয়ে দেব। তারা আপনার ছাত্রদের সঙ্গে বসে হাদিস শুনবে।
ইমাম মালিক বললেন, ‘তাহলে শর্ত এই যে তাঁরা মানুষের ঘাড় ডিঙিয়ে সামনে এসে বসবে না। বরং মজলিসে যেখানে জায়গা পাবে, সেখানে বসবে।’
এ ঘটনা থেকে স্পষ্ট হয় একসময় শিক্ষকের মর্যাদা কেমন ছিল। আমরা দেখলাম দিন দিন শিক্ষকের মর্যাদা কমে গেল। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে এর প্রথম কারণ হিসেবে বলা যায়, রাষ্ট্রের অবহেলা। রাষ্ট্র শিক্ষকদের নানা আঙ্গিকে মর্যাদার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। শিক্ষক সুচারুরূপে তখনই শিক্ষাদান করতে পারবেন, যখন তাঁর জীবনের প্রয়োজনগুলোর জন্য দুশ্চিন্তা করতে হবে না, তাঁর নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে না, তাঁর কাজের ক্ষেত্রকে উৎকর্ষে নিয়ে যাওয়ার জন্য উপকরণের অভাব বোধ হবে না। এসব ক্ষেত্রে রাষ্ট্র কোনো মনোযোগ দেয়নি।
উন্নত বিশ্বের কথা বাদ দিলাম, আমাদের এশিয়ার দেশগুলোতে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের যে বেতন দেওয়া হয়, আমাদের দেশে তা কল্পনা। সিঙ্গাপুর বা সৌদি আরবে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকদের মাসিক সর্বোচ্চ গড় বেতন চার হাজার ডলারের ওপরে অর্থাৎ বাংলাদেশি টাকায় সাড়ে চার লাখের ওপরে বা প্রায় পাঁচ লাখের কাছাকাছি। প্রায় এই রকম বেতন দক্ষিণ কোরিয়া ও চীনে।
কেবল সার্কভুক্ত আমাদের যে প্রতিবেশী দেশ আছে, যেমন ভারত, সেখানে প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষকদের বেতন শুরু হয় ৩৫ হাজার টাকা থেকে। পাকিস্তানে ৩০ হাজার, শ্রীলঙ্কায় ২৭ হাজার, নেপালে ৩৪ হাজার, ভুটানে ৩৩ হাজার ও মালদ্বীপে ৬৩ হাজার টাকা। আর আমাদের বাংলাদেশে প্রারম্ভিক বেতন ১৮ হাজার ৫০০ টাকা (সূত্র: কালের কণ্ঠ)
আমাদের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রায় ৯৭ শতাংশ বেসরকারি। এসব বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা ঠিকমতো বেতনই পান না। যা পান, তা রীতিমতো লজ্জাজনক। আর্থিকভাবে তাঁদের অসম্মানের কারণে সামাজিকভাবেও শিক্ষকদের অবস্থান সুখকর নয়। এ কারণে এ পেশায় আগ্রহী হয়ে কেউ আসতে চান না। যারা আসেন, তারা দায়ে পড়ে। সমাজ তাদের বিব্রত করে।
অনেক জায়গায় শিক্ষককে শারীরিক, মানসিক ও আর্থিকভাবে আঘাত করে। এমনকি যে শিক্ষক সন্তানতুল্য শিক্ষার্থীকে শিক্ষাদান করেন, সেই গুরুর প্রতি কোনো শিষ্য অপবাদ, অপমান এবং লাঞ্ছিত করতেও ছাড়ে না।
শিক্ষকতা পেশায় দক্ষতা অর্জন, তার চর্চা এবং দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রগুলো অনুর্বর এবং অনুন্নত। এখানে শিক্ষকদের নেই ব্যক্তিগত ও পেশাগত দক্ষতা উন্নয়নের জন্য যথাযথ এবং যুগোপযোগী প্রশিক্ষণ।
তবে কি ‘শিক্ষাগুরুর মর্যাদা’ কেবল বইয়ের পাতায়ই শোভা পাবে? রাষ্ট্র, সমাজ এবং সমাজের মানুষের কি কোনো দায়বদ্ধতা নেই! উত্তরে বলা যায়, অবশ্যই আছে। এবার দেখা যাক শিক্ষকদের মর্যাদা সমুন্নত রাখতে কী কী কাজ অবশ্যই করা প্রয়োজন। প্রথমত, শিক্ষকদের সম্মানজনক জীবনধারণের জন্য বেতন–ভাতা বৃদ্ধি করা। শিক্ষকদের ধারাবাহিকভাবে প্রশিক্ষণ প্রদান। শিক্ষকদের পড়াশোনা ও গবেষণা করার সুযোগ প্রদান। টেলিভিশন, পত্রিকা এবং অন্যান্য মিডিয়াতে শিক্ষকদের নিয়ে শিক্ষাসংশ্লিষ্ট কাজ করা; যেটা আমাদের বাংলাদেশে হয় না। জাতীয় শ্রেষ্ঠ শিক্ষক নির্বাচনের একটি পদ্ধতি আছে আমাদের দেশে। এখানে যিনি নির্বাচিত হন, তাঁকে ২৫ হাজার টাকার সম্মানী চেক দেওয়া হয়। এটা কমপক্ষে ১ লাখ টাকা করা উচিত। এ ছাড়া নাগরিক জীবনের নানা রকম সুবিধা শিক্ষকদের জন্য রাখা উচিত।
শিক্ষকদের নৈতিক চরিত্র দৃঢ় না হলে আদর্শের জায়গাটা নড়বড়ে হয়ে পড়ে। তাই শিক্ষকদের হতে হবে নৈতিক, মানবিক, সাংস্কৃতিক গুণাবলিসম্পন্ন, মেধাবী, চিন্তা ও কাজে আন্তরিক সৎ এবং নির্লোভ।
শিক্ষক শব্দের পূর্ণরূপ শিষ্টাচার, ক্ষমা ও কর্তব্যপরায়ণতা। এই তিন গুণ যিনি আয়ত্ত করেছেন, তিনিই শিক্ষক। আর এমন শিক্ষকই গড়ে তুলতে পারেন সত্যিকারের মানুষ, যারা প্রকৃতই জাতির মেরুদণ্ড হিসেবে পরিগণিত হবে।
হাদিসে বলা আছে, ‘আকাশের অগণিত তারা, সমুদ্রের গভীর তলের মাছ ও মাটির গর্তের পিপীলিকা সেই শিক্ষকের জন্য দোয়া করে, যে শিক্ষক সৎ ও সুশিক্ষা দান করেন।’ অথচ আমরা মানুষ হয়ে শিক্ষাগুরুর মর্যাদা যদি না রাখি, তাহলে কী করে মর্যাদাবান নাগরিক দেশে গড়ে উঠবে?
মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলোর মধ্যে শিক্ষা অন্যতম। তাই সভ্যতায় শিক্ষাব্যবস্থার যখন সূচনা হলো, সেই শিক্ষার সঙ্গে নিবিড় হলে জড়িয়ে আছেন শিক্ষক। সেই শিক্ষকদের মর্যাদা না রাখলে সভ্যতাও ঠিক থাকবে না। সাংবিধানিক ভাবে সরকারি দল বা প্রধানমন্ত্রী তার ইচ্ছা অনুযায়ী পুরো ব্যবস্থাকে হেরফের করতে পারেন, যেমনটি গত ১৫ বছরে দেখা গেছে। তাই সরকারি দলকে স্বেচ্ছাচারি হওয়ার জন্য সকল রসদ এই সংবিধানেই রয়েছে। নির্বাহী বিভাগকে আইনসভা থেকে অধিক ক্ষমতাবান করার কারণে বর্তমানে ব্যক্তির মৌলিক অধিকার পরিপন্থী ও নিবর্তনমূলক আইনসমূহ পাস এবং সংশ্লিষ্ট সংস্থা তৈরি করা সম্ভব হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশক্রমে আইনসভার সদস্যগণ বিনাদ্বিধায় এই ধরনের আইন পাস করেছেন।
এছাড়া সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংসদ সদস্যদের ফ্লোর ক্রস করা বা দলের বিরুদ্ধে কথা বলার সুযোগ রুদ্ধ করে দিয়েছে যার ফলে বাংলাদেশের সংসদ মূলত ক্ষমতাসীন দলের গৃহীত পদক্ষেপের জন্য একটি রাবার স্ট্যাম্প হিসাবে কাজ করছে। যেখানে সংসদ সদস্যরা তাদের প্রধানমন্ত্রীর জবাবদিহি নিশ্চিত করার কথা সেখানে উল্টা ৭০ অনুচ্ছেদ দিয়ে সংসদ সদস্যদের এই ক্ষমতা নস্যাৎ করে দেওয়া হয়েছে। তাই ৭০অনুচ্ছেদ বাতিল করা জরুরি।
এসব আলাপ থেকে এটা স্পষ্ট যে চলমান সংবিধানের কাঠামো মূলত একটি কর্তৃত্ববাদী অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রযন্ত্র বলবৎ করার হাতিয়ার হিসেবেই কাজ করেছে এবং বিগত ১০ বছরে আসলে গণতন্ত্রের আড়ালে দেশে ক্রিয়াশীল ছিল ‘সাংবিধানিক স্বৈরতন্ত্র’।ফলে এই সংবিধানের আমূল পরিবর্তন না হলে আমরা আবার নতুন করে কর্তৃত্ববাদী স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্র-কাঠামোতেই ফিরে যাব কেননা নির্বাচনের মাধ্যমে যেই ক্ষমতায় আসবে তাদের দ্বারা আবারো স্বৈরতন্ত্র চালু হবে না এমন কোন গ্যারান্টি নাই। তাই এতবড় একটা গণঅভ্যুত্থানের পর আমাদের কাজ হচ্ছে গণঅভ্যুত্থানকে লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক রিভোলিউশনে রূপ দেয়ার জন্য ফ্যাসিবাদী কাঠামোর খোলনলচে পাল্টে ফেলে জনগণের সাথে ডায়ালগের ভিত্তিতে একটা নতুন গঠনতন্ত্র প্রণয়ন করা। এর মাধ্যমে কিছু মৌলিক উপাদান সেট করা হবে যেমন সার্বজনীন মানবাধিকার, ব্যক্তি মানুষের মর্যাদা সুরক্ষা, মত প্রকাশের স্বাধীনতাসহ তার বিকাশের পথে কোন বাধা না দেয়া এরকম আরও অনেক কিছু- যার ভিত্তিতেই পরে নতুন গণমুখী সংবিধান প্রণয়ন করতে হবে। এর মানে পুরানা সংবিধানকে রদ করে একটা বহুত্ববাদী, ন্যায়বিচারকামি এবং অংশীদারিত্বমূলক গঠনতন্ত্র প্রণয়ন করতে পারবে।
এই গঠনতন্ত্র প্রণয়ন পরিষদ আমূল সংস্কারের মাধ্যমে যে নতুন সংবিধান তৈরি করবে তা আগামীতে যারাই ক্ষমতায় আসবে তাদের কর্তৃত্ববাদী এবং ফ্যাসিবাদী হওয়া থেকে কাঠামোগতভাবেই বাধা দিবে। ইতোমধ্যেই অন্তর্বর্তী সরকার সংবিধান সংস্কারের জন্য একটি সংবিধান সংস্কার কমিশন গঠন করেছেন এবং প্রফেসর ড. আলী রিয়াজকে তার প্রধান নিযুক্ত করেছেন। তবে আমরা মনে করি দায়সারা গোছের সংস্কার নয়, সংবিধানের বৈপ্লবিক পরিবর্তন করতে হবে যেন ব্যক্তি বাংলাদেশির মৌলিক অধিকার এবং মর্যাদা সুরক্ষিত থাকে।
প্রথমত, সংবিধানে আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের সাথে সংহতি রেখে নাগরিকদের মৌলিক অধিকার এবং ব্যক্তির মর্যাদা, স্বাধীনতা এবং স্বাতন্ত্র্যকে রক্ষা করার বেসিক কিছু বিধান রেখে কিছু গাইডলাইন প্রণয়ন করতে হবে এবং এগুলাকে অপরিবর্তনীয় রাখার নিশ্চয়তা দিতে হবে। আইনসভায় আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে এসব বেসিক গাইডলাইন ফলো করা হবে এবং মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী কোন আইন যাতে প্রণয়ন করা না হয় তার দিকে বিশেষভাবে দৃষ্টি দিতে হবে। পাশাপাশি দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা করা যেতে পারে যাতে করে যেকোনো আইন প্রণয়ন বা সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে উচ্চকক্ষের সদস্যগণ মতামত দিতে পারেন। আবার উচ্চকক্ষে শুধু মাত্র এলিট এবং সিভিল সোসাইটির লোকজনের প্রাধান্য না রেখে কৃষক, শ্রমিক সহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হবে।
দ্বিতীয়ত, নির্বাচিত সরকার যেন কর্তৃত্ববাদী হয়ে না উঠে সেজন্য ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ নিশ্চিত করে আইনসভা, বিচার বিভাগ এবং নির্বাহী বিভাগের মাঝে ক্ষমতা শেয়ার করে দিয়ে চেক এন্ড ব্যাল্যান্স নিশ্চিত করতে হবে। আইনসভা এবং বিচার বিভাগের উপর প্রধানমন্ত্রীর যেই প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণ রয়েছে তাকে গণতান্ত্রিক সংস্কারের মাধ্যমে সীমিতকরণের প্রক্রিয়া বের করতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর সাংবিধানিক ক্ষমতাকে কমিয়ে আনতে হবে। একব্যক্তি দুইবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না এবং দলের নেতা হিসেবে থাকবেন প্রধানমন্ত্রী ব্যতীত দলের অন্য কোন সদস্য। আবার প্রধান বিচারপতি, প্রধান নির্বাচন কমিশনার, অডিটর জেনারেলসহ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর পাশাপাশি বিরোধী দলীয় নেতা, সাবেক প্রধান বিচারপতি ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি সর্বদলীয় এবং নিরপেক্ষ নিয়োগ কমিটি গঠনের ধারা সাংবিধানে উল্লেখ করা যেতে পারে।
এ ছাড়া ১৫তম সংশোধনীর মাধ্যমে যে কেয়ারটেকার সরকার পদ্ধতি বাতিল করা হয়েছে তা দেশের চলমান রাজনৈতিক দলসমূহের মাঝে আস্থা এবং নৈতিকতার সঙ্কটের প্রেক্ষিতে যে ভুল সিদ্ধান্ত ছিল তা বোঝা যায় দলীয় সরকারের অধীনে গত তিনটি ইলেকশন ফ্রি, ফেয়ার এবং গ্রহণযোগ্য না হওয়ার প্রেক্ষিতে। তাই এই সংশোধনী বাতিল করে পুনরায় কেয়ারটেকার সরকারের ধারা স্থাপন করা দরকার। এছাড়া সংবিধানের ১৬তম সংশোধনী, ৯৬ অনুচ্ছেদ অর্থাৎ বিচারপতির অভিশংসনের অধিকার বিষয়ে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল থেকে সংসদের উপর অভিশংসনের ক্ষমতা স্থানান্তর করে। এ সংশোধনী তাই ক্ষমতা পৃথকীকরণের মৌলিক ধারণার বিরোধী এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ধারণাকে বিপন্ন করে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হলে ১৬তম সংশোধনীও বাতিল করা দরকার।
রাজনৈতিক দুরভিসন্ধিমূলক অনেক সংশোধনী পার হয়ে এদেশের সংবিধান গত দেড় দশক ধরে যেভাবে কর্তৃত্ববাদী শাসনের মাধ্যম হয়ে উঠেছে তা থেকে গণতান্ত্রিক কাঠামোতে উত্তরনের যে কোন প্রচেষ্টাকে রুদ্ধ করে দেয়ার জন্য এমনকি সংবিধানের ৭(খ) অনুচ্ছেদের অবতারনা করা হয়। এই ৭(খ) এর দোহাই দিয়েই অনেকে চলমান সাংবিধানিক কাঠামোর ভিতর থেকেই গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ের রাজনৈতিক সঙ্কটের মীমাংসা চাচ্ছেন। কিন্তু আমরা মনে করি কর্তৃত্ববাদী শাসনের রক্ষাকবচ হিসেবে যে সংবিধান কাজ করেছে তার প্রেক্ষিতে নতুন গণতান্ত্রিক সংবিধান রচনাই উদার গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গঠনের প্রথম ধাপ হওয়া দরকার।
See why other supporters are signing, why this petition is important to them, and share your reason for signing (this will mean a lot to the starter of the petition).
This petiton does not yet have any updates
At 100,000 signatures, this petition becomes one of the top signed on amarabedon.com!
By signing you are agree to the followingTerms & Condition and Privacy Policy.
Reasons for signing.
See why other supporters are signing, why this petition is important to them, and share your reason for signing (this will mean a lot to the starter of the petition).