‘রাত একটা। আজিমপুর কলোনি নিশ্চুপ। আধঘণ্টা আগে একটা কল এসেছিল, কোয়ার্টারে কিছু একটা ঘটছে। আরেকটা কল। অনলাইন হয়ে দেখি, কিছু মানুষ অস্থির হয়ে গিয়েছে। বলছে, সাবধান! সাবধান! সাবধান! ঘরের সব বাতি নিভিয়ে দিলাম। বারান্দা থেকে নিচে উঁকি দিয়ে দেখি, রঙের পোশাকে কিছু মানুষ নিঃশব্দে, ধীরপায়ে হেঁটে আসছে। যেন চুপি চুপি কারও কাছে গিয়ে আচমকা ‘ভাউ’ বলে চমকে দিবে। দুইজন, পাঁচজন, বিশজন! আর গুনতে পারলাম না। সমস্ত কলোনি ঘুটঘুটে অন্ধকার, সকল ফ্ল্যাটের বাতি নেভানো। কেমন একটা থমথমে পরিবেশ। হৃদয়হীন দুটো গাড়ি হলুদ বাতি জ্বালিয়ে টহল দিচ্ছে। হঠাৎ কারোর ইন্টারকম বেজে উঠল। মুহূর্তে টেলিফোনের শব্দ আতঙ্কে পরিণত হলো। আমি টেলিফোনের দিকে তাকিয়ে আছি। অস্থির হয়ে অপেক্ষা করছি প্রভাতের। কী ভয়ংকর রাত! কতটা দমবন্ধকর!’
একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্নালিজম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী ফাইজা নোহান সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ফেসবুকে এ পোস্ট দিয়েছেন। কী সহজ-সরল বর্ণনা; কিন্তু চোখ বুজলেই মনে হয় আতঙ্কে গা শিউরে ওঠে। গা ছমছম ভয়ংকর এক অনুভূতি।
কয়েক দিন ধরে ফেসবুকজুড়ে একের পর এক এমন পোস্ট নিশ্চয়ই অনেকের চোখে পড়েছে। সবখানেই একটি বাক্যের উল্লেখ—কবে হবে ভোর, কবে শেষ হবে রাত।
কোটা সংস্কারে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ও পরবর্তী সংঘর্ষ-সহিংস পরিস্থিতিতে এখন পর্যন্ত দুই শতাধিক ছাত্র-জনতা হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। সরকার সর্বোচ্চ বলপ্রয়োগের মাধ্যমে সেই আন্দোলন দমন করেছে।
পাশাপাশি মন্ত্রীরা বলছেন, শিক্ষার্থীদের দাবি তাঁরা মেনে নিয়েছেন। সেই দাবির মধ্যে ছিল, আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে করা সব মামলা প্রত্যাহার করতে হবে এবং আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত সব শিক্ষার্থীকে সব ধরনের রাজনৈতিক, আইনি বা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের মাধ্যমে হয়রানি করা যাবে না।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হকও বলেন, আন্দোলন করার কারণে কোনো সাধারণ শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলা হবে না। যারা সরকারি বিভিন্ন স্থাপনায় ও ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে, সে ব্যাপারে মামলা হবে। শুধু তা-ই নয়, তিনিসহ কয়েকজন মন্ত্রী বলে আসছেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা সরকারি বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা, সহিংসতা বা ধ্বংসযজ্ঞে চালায়নি।
কিন্তু আমরা কী দেখছি? রাজধানীসহ গোটা দেশে আন্দোলনকে ঘিরে যেসব মামলা হচ্ছে, সেখানে নাম ধরে ধরে আসামি করা হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। আরও ভয়াবহ হচ্ছে, একেকটি মামলায় এক-দেড় হাজার করে অজ্ঞাতনামা আসামি রাখা হচ্ছে।
সেই আসামিদের ধরতে রাজধানীর এলাকায় এলাকায় ব্লক রেইড চালানো হচ্ছে। কয়েকটি বাহিনী দিয়ে একেকটি এলাকা ঘিরে ফেলা হচ্ছে। হেলিকপ্টার থেকে সার্চলাইট ফেলে পুরো এলাকা আলোকিত করা হচ্ছে। যেন কেউ সরে পড়তে না পারে। শুধু তা-ই নয়, এ গ্রেপ্তার অভিযান যাতে কেউ তাৎক্ষণিক ফেসবুকে লাইভ করতে না পারে সে জন্য ওই এলাকার ব্রডব্যান্ড লাইনও নাকি কেটে দেওয়া হচ্ছে।
ফেসবুকের টাইমলাইন স্ক্রল করলে গ্রেপ্তার ও নিখোঁজ শিক্ষার্থীদের নিয়ে একের পর এক পোস্ট। বড় ভাই বলছে ছোট ভাইকে তুলে নিয়ে গেছে। ছোট বোন প্ল্যাকার্ড নিয়ে ছবি দিয়েছে, ভাইয়ের খোঁজ চাই। শিক্ষক প্রতিবাদ জানিয়েছেন, আমার ছাত্রকে মুক্তি দিন। রাত হলেই ফেসবুকে সতর্কবাণী—আজকে অমুক অমুক এলাকায় রেইড চলছে। স্বজন, বন্ধুবান্ধব বা পরিচিত—কাকে ধরে নিয়ে যায়, সেই দুশ্চিন্তায় আরও মানুষের ঘুম নেই।
পুলিশের সঙ্গে অস্ত্রধারী ছাত্রলীগ–যুবলীগের নেতাকর্মীরা নেমেছিল শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করতে। পত্রপত্রিকা ও টিভি চ্যানেলেই দেখা গেছে, শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি করতে তাঁদের। অথচ এখন পর্যন্ত একজনও অস্ত্রধারীকে ধরা হলো না।
আর শিক্ষার্থীদের ধরা হবে না বলা হলেও দেখা যাচ্ছে, তাদেরকেই গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। রাজধানী ঢাকায় দেখা যাচ্ছে, মোট গ্রেপ্তারের ৮৬ দশমিক ৮৪ শতাংশই হচ্ছে শিক্ষার্থী, শ্রমজীবী ও সাধারণ মানুষ।। অর্থাৎ কোনো দলের সঙ্গে তাঁদের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই।
আন্দোলনে ছিল কি ছিল না, তার কোনো বাছবিচার করা হচ্ছে না। দশ–বারো দিন আগ থেকে নিখোঁজ এমন শিক্ষার্থীও রয়েছে। এক শিক্ষার্থীও দেখলাম, যে এবার এইচএসএসি পরীক্ষা দিচ্ছিল।
শুধু শিক্ষার্থী নয়, বিভিন্ন পেশার সাধারণ মানুষকে তুলে নিয়ে আসা হচ্ছে। দিনমজুর, রিকশাচালক, সাধারণ চাকরিজীবী, দোকানদার, ছোটখাটো ব্যবসায়ী—কাউকেই ছাড় দেওয়া হচ্ছে না। এক টিভি চ্যানেলের ভিডিও প্রতিবেদনে এক মা আহাজারি করে বলছেন—আমার ছেলেরে বাজারে পাঠাইছিলাম। সে তো ভার্সিটিতেও পড়ে না। ইয়াং ছেলে পেয়ে আমার ছেলেরে ধরে নিয়ে গেছে। ইয়াং ছেলে দেখলেই কি ধরে নিয়া যায়া লাগব?
আন্দোলনের সমন্বয়কারীদের ‘নিরাপত্তা হেফাজতে’ রাখা নিয়ে কী হলো বা হচ্ছে তা তো আমরা দেখতেই পেলাম। দেশজুড়ে থাকা সমন্বয়কারীদেরও তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। মধ্যরাত বা ভোররাতে একেকজনকে তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, কে বা কারা নিয়ে যাচ্ছে, কোথায় নিয়ে যাচ্ছে কেউ জানছেন না দীর্ঘ সময় ধরে।
অনেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। শিক্ষার্থীদের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়কারীর খোঁজে গ্রাম থেকে চলে এসেছেন তাঁর বাবা। চট্টগ্রামের রাস্তায় রাস্তায় থানায় থানায় ছেলেকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন তিনি।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়কারীকে তুলে নিয়ে যাওয়ার দীর্ঘ সময় পর স্বীকার করা হলো। তাঁকে করা হলো রাজধানীতে সেতু ভবন নাশকতায় পুড়িয়ে দেওয়ার মামলার আসামি। অথচ তিনি আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন রাজধানীর বাইরে সাভারে নিজের ক্যাম্পাসে।
সংবাদমাধ্যমে কাজ করার কারণে গ্রেপ্তার ও নিখোঁজ ব্যক্তিদের বিষয়ে উদ্বিগ্ন বন্ধু-স্বজনদের একের পর এক ফোন পাচ্ছি কয়েক দিন ধরে। রাতের বেলায় যে গণগ্রেপ্তার অভিযান চলছে তা নয়, দিনদুপুরে দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকে তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এক বন্ধু ফোন করে এমন ঘটনা জানান। তুলে নেওয়া তরুণকে ছাড়িয়ে আনতে থানা থেকে টাকাও চাওয়া হচ্ছে বলে তিনি অভিযোগ করেন।
একজন জানান, তাঁর এক খালাতো ভাইকে খেলার সময় আটক করে পুলিশ। কিশোর ছেলে। পরে কোনোভাবে ছাড়িয়ে আনে তার পরিবার। এক কিশোরকে ধরে নিয়ে গিয়ে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে হত্যা মামলায়। তাকে রিমান্ড দিলে সমালোচনার পর তা বাতিল করেন আদালত।
গত রোববার দেখা হলো রাজধানীর মগবাজার এলাকায় এক সাবেক সহকর্মীর সঙ্গে। বর্তমানে একটি আইটি ফার্মে কাজ করেন। তিনি বোনের বাসায় যাচ্ছেন নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে।
তিনি জানান, তাঁর এলাকায় ছাত্রলীগ-যুবলীগের ছেলেরা তাকে আন্দোলনকারী হিসেবে চিহ্নিত করেছে। ওই তরুণ এ-ও জানান, তাঁর এলাকায় কয়েকজনকে পুলিশ ধরে নিয়ে গিয়েছিল। দুজনকে ছাড়িয়ে আনতে লাখ টাকা করে দেওয়া লেগেছে। এমনকি একজন রিকশাচালক থেকেও হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে ২০ হাজার টাকা। এমন ভয়াবহ দুঃসময়েও গণগ্রেপ্তারে ‘পুলিশি বাণিজ্য’ থেমে নেই।
রাস্তায় রাস্তায় মুঠোফোন চেক আন্দোলন-সংক্রান্ত কিছু পেলেই গ্রেপ্তার করছে পুলিশ। কারও মুঠোফোন চেক করার অধিকার তো পুলিশ রাখে না। এটা তো মানুষের গোপনীয়তা সুরক্ষার ভয়াবহ লঙ্ঘন। গোটা পরিস্থিতি নিয়ে প্রবীণ আইনজীবী জেড আই খান পান্না আদালত প্রাঙ্গণে সাংবাদিকদের সামনে যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা-ই যেন আজ দেশের প্রত্যেক মানুষের মনের কথা।
আইনজীবী জেড আই খান পান্না বলেন, ‘পাকিস্তানি হানাদাররা দরজায় ঠক ঠক করত এবং জিজ্ঞাসা করত, মুক্তি আছে কি না। আর ২০২৪ সালে দেখলাম, যে দেশটা আমরা রক্তের বিনিময়ে স্বাধীন করলাম, সেই দেশে ব্লক রেইড দিয়ে রাতের অন্ধকারে ঠক ঠক করে জিজ্ঞাসা করে কোনো ছাত্র আছে কি না। যদি থাকে মুঠোফোন চেক করে, রাস্তাঘাটেও করে। কোন আইনে কোন অধিকারবলে এটি করে।’
তিনি বললেন, ‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সম্ভবত রোজা লুক্সেমবার্গের একটি ডায়েরি আছে, নাৎসিরা পর্যন্ত তো সেটি চেক করিনি, যেটি আজকের বাংলাদেশে করা হচ্ছে। আমার মুঠোফোন, আমার ডায়েরি, আমার প্যান্ট চেক করবে যে কেউ, এই অধিকার তো কাউকে দেওয়া হয়নি। যদি কারও বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকে, থানায় ডায়েরি হবে, সে মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু এখন যা চলছে, তার তো কোনো যুক্তি নেই।’
আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের গণগ্রেপ্তার ও নির্বিচারে আটক নিয়ে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলছে, বাংলাদেশে যে ভয়ের পরিবেশ রয়েছে, তা আরও জোরালো করতে গণগ্রেপ্তার ও আটককে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে কর্তৃপক্ষ। এই গ্রেপ্তারগুলো সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দশ্যপ্রণোদিত। সরকারকে চ্যালেঞ্জ করার সাহস করেন, এমন যে কারও মুখ বন্ধ করতে এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
ভাইকে ডিবি পরিচয়ে তুলে নিয়ে গেছে অভিযোগ করে ফেসবুকে একজন লিখেছেন এভাবে, ‘নিজেকে শক্ত রাখতে পারলেও আম্মুর আহাজারিতে নিজেকে খুব অসহায় মনে হচ্ছে। তবে ভেঙে পড়িনি, শুধু মনের ভেতর যেটা কাজ করছে সেটা হলো রাগ, ক্ষোভ আর প্রতিহিংসা। আমার ভাইয়ের মতো এ রকম হাজারো ভাই আছে যারা এখনো নির্যাতিত হচ্ছে, শত শত ভাই নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন। ওদের দেখতে দেখতে কলিজা শক্ত হয়ে গেছে।’
শিক্ষার্থীদের গ্রেপ্তার, নির্যাতন ও নিপীড়ন চালিয়ে দিন শেষে ফল কী হবে ভাবছে কি সরকার? এসব দেখে দেখে ‘কলিজা শক্ত’ হয়ে যাচ্ছে আরও যেসব শিক্ষার্থী ও তরুণের, ভবিষ্যতে তাদের কীভাবে রুখবে?
See why other supporters are signing, why this petition is important to them, and share your reason for signing (this will mean a lot to the starter of the petition).
This petiton does not yet have any updates
At 100,000 signatures, this petition becomes one of the top signed on amarabedon.com!
By signing you are agree to the followingTerms & Condition and Privacy Policy.
Reasons for signing.
See why other supporters are signing, why this petition is important to them, and share your reason for signing (this will mean a lot to the starter of the petition).